আজ খবর ডেস্ক : স্তন্যপায়ীদের দেহে দ্রুত কমে যাচ্ছে শুক্রাণুর সংখ্যা । ফলত হারিয়ে যাচ্ছে যৌনক্ষমতা। আর এর কারণ উত্তরোত্তর বেড়ে চলা বায়ু দূষণ। আর জানা যাচ্ছে মস্তিষ্কের এক প্রোটিন এই শুক্রাণু কমে যাওয়ার মূল কারণ।এতদিন পর্যন্ত এই নিয়ে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে। শেষ মেশ সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার যথার্থ কিনারা করতে পারল গবেষকরা। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘এনভায়রনমেন্টাল হেল্থ পারস্পেক্টিভ্‌স’-এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে । মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী মিলে এই গবেষণাটি চালিয়েছে। সেই দলে রয়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বঙ্গসন্তান গবেষকও। নাম সমুদ্র চট্টোপাধ্যায়।গবেষণায় দাবি করা হচ্ছে, বায়ুদূষণের কারণে যে শুক্রাণু সংখ্যা কমছে, তার মূল কারণ হলো মস্তিষ্কের এক প্রোটিন।

এ ব্যাপারে সমুদ্র চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, পরীক্ষাটি একটি সুস্থ ইঁদুরের উপর চালানো হয়ে। তাতে তাঁরা দেখেছেন, বাতাসে ভেসে থাকা সূক্ষাতিসূক্ষ দূষণ কণাগুলির ব্যাস আড়াই মাইক্রোমিটার (মিটারের এক হাজার ভাগ মিলিমিটার। আর মিলিমিটারের এক হাজার ভাগ মাইক্রোমিটার) বা তার চেয়েও কম। এই কণাগুলি প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকলে মস্তিষ্কে একটি বিশেষ ধরনের প্রদাহ (‘ইনফ্ল্যামেশন’) তৈরি হয়। সেই প্রদাহই শুক্রাণুর সংখ্যা খুব দ্রুত কমিয়ে দেয়। যে কারণে কমে যেতে থাকে যৌনক্ষমতা ও প্রজননশক্তিও।বাতাসে ভেসে থাকা অতি সূক্ষ্ম দূষণ কণাগুলিকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম)’ বলা হয়। এরা নানা আকারের হতে পারে। যেগুলির ব্যাস আড়াই মাইক্রোমিটার সেগুলির নাম- ‘পিএম২.৫’।সমুদ্রের মতে, ‘‘এত দিন জানা ছিল, শুক্রাণুর সংখ্যা, যৌনক্ষমতা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ মানসিক বা শারীরিক অবসাদ। তার ভিত্তিতে চিকিৎসাও চলে। কিন্তু দূষিত বাতাসও যে এ ব্যাপারে বড় ভূমিকা নেয়, তা আন্দাজ করা গেলেও সেটা কী ভাবে হয় তা জানা যায়নি এর আগে।’’

এই পরীক্ষার মূল গবেষক মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঝেকাঙ ইং জানিয়েছেন , ‘‘এটা ঠিক যে, ইঁদুরের ক্ষেত্রে পরীক্ষাটি করা হয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রেও কারণটা এক কি না, তা এখনও পর্যন্ত খতিয়ে দেখা হয়নি। তবে ইঁদুরের উপর এই পরীক্ষার ফলাফল পরিবেশ দূষণের দৌলতে মানুষের শুক্রাণুর সংখ্যা, যৌনক্ষমতা ও প্রজননক্ষমতা কমে যাওয়া রুখতে নতুন কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কারের পথ খুলে দিতে পারে আগামী দিনে।’’

গবেষণার নতুনত্ব কোথায়?

সমুদ্র ও ঝেকাঙ দু’জনেই জানান, দূষিত বাতাস মানুষের ফুসফুস, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কের উপর যে খারাপ প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে আগের বিভিন্ন গবেষণায় বহু তথ্য জানা গিয়েছিল। কিন্তু সেই বাতাসের দূষণ কণা যে আমাদের শুক্রাণুর সংখ্যা, যৌন ও প্রজননক্ষমতাও কমায় তা তখনও পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছিল না। ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে এবার সে ব্যাপারে কিছুটা বোঝা গেল।মানুষের প্রজনন ক্ষমতা ক্রমশ কমে যাওয়া নিয়ে বিশ্বজুড়েই গবেষণা চলছে। সমসাময়িক সময় তার গতি আরও বেড়ে গিয়েছে । পশ্চিমী দেশগুলিতে গত দু’দশকে মানুষের শুক্রাণুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেতে দেখা গেছে। কি কারণে সেটা হচ্ছে তা নিয়ে যথেষ্টই সংশয়ে ছিলেন সেখানকার বিজ্ঞানীরা। দূষিত বাতাস যে মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর শুক্রাণুর সংখ্যা দ্রুত কমিয়ে দিচ্ছে, সে বিষয়টিও বিভিন্ন গবেষণার মধ্য দিয়ে উঠে আসছিল। কিন্তু কী ভাবে সেটি ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। এইখানেই অভিনবত্ব সমুদ্র ও ঝেকাঙের গবেষণার।

সমুদ্র বলেন, ‘‘এর আগের কয়েকটি গবেষণা জানিয়েছিল, বাতাসের দূষণ কণার মাত্রাবৃদ্ধিতে (বিশেষ করে, পিএম২.৫ কণার আধিক্যে) মানুষের অন্ডকোষে প্রদাহ দেখা দিচ্ছে। কিন্তু পরে অন্য কয়েকটি গবেষণায় দেখা যায়, বাতাসে দূষণ কণার মাত্রাবৃদ্ধিতে অন্ডকোষে প্রদাহ হচ্ছে না। ফলে, সংশয় থেকেই গিয়েছিল। কারা আদতে কলকাঠি নাড়ছে, বোঝা যাচ্ছিল না। আমাদের গবেষণা সে ক্ষেত্রে আলোকপাত করল।’’

পরীক্ষায় কি কি ফল পাওয়া গেছে ?

সমুদ্র ও ঝেকাঙ জানিয়েছেন, তাঁরা সুস্থ, সবল ইঁদুরদের উপর পরীক্ষা চালিয়েছেন। তাদের এমন পরিবেশে রাখা হয় যেখানে বাতাসে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে পিএম২.৫ দূষণ কণা, তার ফলে তাদের শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যায়। তাদের মস্তিষ্কের সামনের দিকে থাকা হাইপোথ্যালামাস অংশে গভীর প্রদাহের সৃষ্টি হয়। এটি পিটুইটারি গ্রন্থির সঙ্গে গোনাডাল গ্রন্থিকে যুক্ত করে। যা প্রজননক্ষমতা তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনগুলি তৈরি করে।গবেকরা ইঁদুরের মস্তিষ্কের এই অংশেই একটি বিশেষ প্রোটিনের হদিশ পেয়েছেন গবেষকেরা। যার নাম- ‘ইনহিবিটর কাপ্পা-বি কাইনেজ-২’।

সমুদ্র বললেন, ‘‘এই প্রোটিনটি যখন আমরা ইঁদুরের মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে নিয়েছি তখন কিন্তু দেখেছি, বাতাসে পিএম২.৫ দূষণ কণা প্রচুর পরিমাণে রয়েছে এমন পরিবেশে রাখলেও ইঁদুরদের শুক্রাণুর সংখ্যা, যৌন ও প্রজনন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে না। এর থেকে বোঝা গিয়েছে, এই প্রোটিনটিই আদতে কলকাঠি নাড়ছে। তাই মস্তিষ্কের ওই অংশে ওই প্রোটিনটিকে যদি কোনও ওষুধ দিয়ে আটকে বা বেঁধে ফেলা হয় তা হলে দূষণের কারণে শুক্রাণুর সংখ্যা, যৌন ও প্রজনন ক্ষমতা আর কমবে না’’।তবে গবেষকদের মতে, এই গবেষণার চূড়ান্ত কথা অবশ্য বলবে মানুষের মস্তিষ্কের উপর পরীক্ষার ফলাফল। যার প্রস্তুতিও ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *