ত্রয়ণ চক্রবর্তী (সাংবাদিক):
২০০৮ সালে এই রাজ্যে পঞ্চায়েত স্তরে প্রথম পালা বদল হয়েছিল। প্রায় তিন দশকের বাম জমানায় সে বছর দুটি জেলা পরিষদ, পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা দখলে নিয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস। রাত পোহালেই পঞ্চায়েত ভোট রাজ্যে। একদিকে বিরোধীদের দুর্নীতির অভিযোগ, শাসকের বিরুদ্ধে “চোর ধরো জেল ভরো” স্লোগান, আর অন্যদিকে ২০২৪ লোকসভা ভোটকে টার্গেট করে তৃণমূল কংগ্রেসের বিজেপি বিরোধী প্রচার। এই আবহে পঞ্চায়েত ভোটের জল কোন দিকে গড়াবে? প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হওয়া গায়ে লাগাবে কোনও জেলা পরিষদ?
একজন বাম নেতার সঙ্গে ২০১৩ তে একান্তে কথা হয়েছিল। বললাম, “ছেলেপুলে গুলো কী করছে?” উত্তরে বলেছিলেন, চিড়িয়াখানার বাঘকে হঠাৎ করে সুন্দরবনে ছেড়ে দিলে, সে শিয়াল দেখলেই পালাবে। আসলে এতদিন বামফন্ট সরকার ছিল।”
যাইহোক, লেখার বিষয় এই নির্বাচনে বিরোধীদের সম্ভবনা।
রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের সম্ভাবনা মূলত উত্তরবঙ্গে তিন জেলা, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়িতে। অন্তত, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সমীক্ষকরা তাই বলছেন। বিরোধী শিবিরেও চাপা ফিসফাস চলছে। সিপিএম নামিয়েছিল যুব ফ্রন্টকে উত্তরবঙ্গ অভিযানে। মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, দিপ্সিতা ধর, শতরূপ ঘোষরা প্রচার করেছেন, সেখানে আমজনতার ভিড়ও হয়েছে চোখে পড়ার মত। উত্তরবঙ্গবাসীর মনে চিরাচরিত বঞ্চনার যে ক্ষোভ আছে তাতেই সলতে পাকানোর কাজ নাকি সেরেছে গেরুয়া শিবির। ফলে উলট পুরাণের সম্ভাবনা। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে শীতলখুচিতে যে ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা মাথায় রেখে সতর্ক জেলা প্রশাসন। তবে কোচবিহারের প্রাক্তন ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা কমল গুহর গড় এখন প্রায় ভেঙে পড়েছে। আর এতেই অশনি সংকেত দেখছে জেলার সাধারণ মানুষ। কমলপুত্র উদয়ন গুহু এখন তৃণমূল কংগ্রেসে। তৃণমূলের অনেক দাপুটে নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে সরিয়ে উদয়নের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়াকে জেলা তৃণমূলের অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না। উল্টো দিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের নামে একাধিক নেতিবাচক প্রচার চালিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু স্থানীয় যুবদের মধ্যে তাঁর প্রভাব যথেষ্ট। স্বীকার করছেন অনেকেই।
রাজনীতির সূত্র বলে, ফাঁকা জায়গা থাকে না, অর্থাৎ এই যে উত্তরবঙ্গে গত বিভিন্ন নির্বাচনে মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল, তারা কী করবেন? আমার মনে হয় সেটা বামপন্থীদের পক্ষে ফিরতে পারে, তবে এতটাও ফিরতে পারে না যে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত দখল করবে। আবার তৃনমূলের পক্ষে যাবে, এমন না হওয়ারই কথা। কারণ ওই যে কথা ছিল, কথা বাকি আছে, আরও কত কথা হবে। কথা হয়েছে ভাত পায়নি। আরেকটু নিচের দিকে গঙ্গার পারে মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ বাম ও তার জোট সঙ্গী কংগ্রেসের দখলে যেতে পারে।
দক্ষিণ বঙ্গের আরেক নজর কারা জেলা বীরভূম। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ভিন রাজ্যে কারাবাস করছেন। ফলে এই জেলার বিরোধী শিবির কিঞ্চিত স্বস্তিতে। আমার অনুমান সেখানে পরিবর্তন হয়তো হবে না। পূর্ব বর্ধমানে কিছুটা বামপন্থীরা ভালো ফল হতে পারে। নদীয়াতে ক্ষীরদই হরিশ মুখার্জি রোডের দিকে ঝুঁকে বলেই মনে হয়। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় ঘাস ফুল ফোটার সম্ভাবনা, কারণ এত পরিমানে মনোনয়ন প্রত্যাহার। এমনকি হতাশ করেছে নওশাদ সিদ্দিকীর ভাঙড় ও। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর অর্থাৎ জঙ্গলমহল পলাশের দেশ। তৈরি কুর্মী সম্প্রদায়ও। সেটা যদি রক্ত পলাশ হয়, হতে পারে তা বামেদের দিকে। পশ্চিম মেদিনীপুরে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে প্রায় ৭০০র ও বেশি আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি শাসক দল। জঙ্গলমহলে সংগঠনের হাল ফেরাতে দিনের পর দিন মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন প্রবীণ সিপিআইএম নেতা রবীন দেব থেকে তরুণ নেতা কলতান দাশগুপ্ত ও ইন্দ্রজিৎ ঘোষ। সমুদ্র জঙ্গল। পশ্চিমবঙ্গে এর সব আছে। জঙ্গলমহলে দুই ফুলের লড়াই হয়তো হতে পারে। তবে পিছিয়ে নেই লাল ঝাণ্ডার পার্টি ও। লেখার শেষে এটাই বলা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা লাইন ছিল, রক্তপাত ছাড়া পৃথিবীর মাটি ঊর্বর হয় না। আমার বলা এটাই যে, আর রক্তপাত যেন না হয়!