আজ খবর ডেস্ক : বয়স ধরে রাখতে মানুষ কী না করে। কিন্তু কালের নিয়মে বার্ধক্য আশা কি আর ঠেকানো যায় ? যদি বলি হ্যাঁ! অবাক হচ্ছেন ? এই অসম্ভবকেই সম্ভব করার দিশা দেখালো একদল আমেরিকান বিজ্ঞানী।কোন ওষুধপত্র না, শুধু মাত্র একটা টিকার সাহায্যে দূর হতে পারে বার্ধক্য। আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিং (এনআইএ)’-এর বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের উপর এই পরীক্ষাটি চালায়। আর গত ১০ ডিসেম্বর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার এজিং’-এ। ইঁদুরের উপর সফল হয়েছে ওই পরীক্ষা। তাই এবার বিশেষজ্ঞদের দাবি, ‘‘মানুষের উপর সফল হলে এই টিকা একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। যার জন্য মানুষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সভ্যতা আধুনিক হয়ে ওঠার আগে থেকেই।’’

কী ভাবে করা হয় পরীক্ষাটি ?

গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়েছে, পরীক্ষায় সফল টিকাটি ইঁদুরের শরীর থেকে বার্ধক্য জনিত কারণে অথর্ব হয়ে পড়া কোষগুলিকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। তার ফলে, ইঁদুরের আয়ু বেড়েছে। সেই সঙ্গে তাদের বার্ধক্যজনিত অনেক রোগও পুরোপুরি নির্মূল হয়ে গিয়েছে।মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অন দ্য বায়োলজি অব এজিং অ্যান্ড মেটাবলিজমের সহকারী অধিকর্তা অধ্যাপক পল রবিন্স – এর মতে, ‘‘অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য গবেষণা। গবেষকরা যে পথ ধরে এগিয়েছেন তাতে তাত্ত্বিক ভাবে এই টিকার পরীক্ষা মানুষের উপরেও সফল হওয়া উচিত। তবে মানুষের আগে আরও কয়েকটি মনুষ্যেতর স্তন্যপায়ীর উপর এই পরীক্ষা চালিয়ে দেখা উচিত।’’

টিকা বানাতে কোন কোন কোষের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন গবেষকেরা ?

এনআইএ জানিয়েছে, সেনেসেন্ট কোষ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অত্যধিক চাপ বা অন্য যে কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে এই কোষগুলির স্থিতিস্থাপকতা (‘ইলাস্টিসিটি’) সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট হয়ে যায়। তখন কোষগুলি আর বিভাজিত হতে পারে না। কিন্তু তাতে কোষগুলি মরে যায় না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সেনসেন্ট কোষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আর সেগুলি দ্রুত দেহে জমতে থাকে। এই কোষগুলির সরানো তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে, ফলত দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এই সেনেসেন্ট কোষগুলি থেকে এক ধরনের যৌগের ক্ষরণ হয়। যা দেহে নানান ধরনের প্রদাহ (‘ইনফ্ল্যামেশন’) সৃষ্টি করে। ফলে, সেনেসেন্ট কোষগুলির আশপাশে থাকা সুস্থ সবল কোষগুলিও প্রচুর ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর আগে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শরীরে এই সেনেসেন্ট কোষগুলির বৃদ্ধির জন্যই ক্যানসার, অ্যালঝাইমার্স এবং স্ক্লেরোসিসের মতো বার্ধক্যজনিত একাধিক জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। সামনে বাধার দেওয়াল (‘আর্টারি প্লেক্‌স’) তৈরি হয়ে যাওয়ায় ধমনীতে রক্ত চলাচল থেমে যায়। সেগুলি আর সরানো সম্ভব হয় না।

ওষুধের থেকে টিকার কার্যকারিতা কেন বেশি ?

সেনেসেন্ট কোষগুলি সরানোর জন্য গত এক দশক ধরেই আমেরিকায় নানান ধরনের ওষুধ তৈরির চেষ্টা চলছে। তাদের কোনও কোনওটির এখনও হিউম্যান ট্রায়ালে রয়েছে।রবিন্স- এর কথায়, ‘‘তবে ওই সব ওষুধের চেয়ে টিকার কার্যকারিতা অনেক বেশি হবে বলেই আশা করছি। কারণ, ওষুধ তো ব্যবহৃত হবে দেহে সেনেসেন্ট কোষ জমতে জমতে পাহাড়ে পরিণত হওয়ার পর। তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। দেহের সুস্থ কোষগুলির ততক্ষণে অনেকটাই ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলিও। কিন্তু ৫০ বছর বয়স হলেই যদি এই টিকা দেওয়া সম্ভব হয়, তা হলে শরীরে এই সেনেসেন্ট কোষ গড়েই উঠতে পারবে না। জমতে জমতে পাহাড় হয়ে ওঠা তো অনেক দূরের কথা। টিকা দিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলিকে এমন ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে যাতে সেনেসেন্ট কোষ তৈরি হচ্ছে দেখলেই তারা তাদের নিকেশ করে দিতে পারে।’’

তবে সমস্যা কোথায়?

কিন্তু এর একটি সমস্যা রয়েছে। এই সেনেসেন্ট কোষগুলি দেহের সর্বত্রই তৈরি হয়। তবে দেহের এক জায়গার সেনেসেন্ট কোষের সঙ্গে অন্য জায়গার সেনেসেন্ট কোষের প্রকৃতিগত ভাবে কোন মিল থাকে না।গবেষকরা একটি বিশেষ ধরনের সেনেসেন্ট কোষের উপর নজর রেখেছিলেন। যেগুলি তৈরি হয় মূলত ধমনী, শিরা ও রক্তজালিকার একেবারে ভিতরের দিকে থাকা এন্ডোথেলিয়াল কোষগুলিতে। এগুলিকে বলা হয়— সেনেসেন্ট ভাসক্যুলার এন্ডোথেলিয়াল কোষ।

গবেষকদের বিশেষ কোষ অনুসন্ধানের কারণ কি?

সেই কোষগুলি তাঁরা খুঁজে বের করেন , যেই কোষগুলির উপরের স্তরে প্রোটিনটিকে বেশি পরিমাণে দেখা যাচ্ছে। কারণ, গবেষকদের লক্ষ্যই ছিল সেই প্রোটিনটিকে তাঁদের বানানো টিকার লক্ষ্যবস্তু করার।গবেষকরা তেমন একটি প্রোটিন খুঁজে পান। যার নাম হল ‘গ্লাইকোপ্রোটিন ননমেটাস্ট্যাটিক মেলানোমা প্রোটিন বি ’ (জিপিএনএমবি)। বার্ধক্যজনিত বেশ কিছু জটিল রোগ, মেলানোমা-সহ কয়েক ধরনের ক্যানসারের ক্ষেত্রে এই প্রোটিনটিতেই বেশি পরিমাণে সেনেসেন্ট কোষ জমতে দেখা যায়।মানব দেহকোষ নিয়েও এই সংক্রান্ত পরীক্ষা চালিয়ে গবেষকরা দেখেছেন, স্ক্লেরোসিস রোগীদের সেনেসেন্ট কোষে এই প্রোটিনটির আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। এই প্রোটিনের পরিমাণ বৃদ্ধি হলেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধমনীতে রক্ত সংবহন বাধাপ্রাপ্ত হয়।পরীক্ষাটি চালান হয়েছিল মূলত মধ্যবয়সী ইঁদুরের উপর । যাতে তাদের বার্ধক্য ও বার্ধক্যজনিত রোগের গতিতে নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব কি না তা বোঝা যায়। পরীক্ষার শেষে দেখা গিয়েছে, ইঁদুরের ক্ষেত্রে টিকাটি ৯৫ শতাংশ সফল হয়েছে । তাই এবার মানুষের ক্ষেত্রেও এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে পারে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *