আজ খবর এক্সক্লুসিভ: চাকরির দাবিতে বিক্ষোভ, অনশন নতুন কিছু নয়। সেইসঙ্গে গত বছর খানেক ধরে এই রাজ্যে তৈরি হয়েছে এক নতুন ঘটনা বিন্যাস। তা হল, চাকরির দাবিতে বিক্ষোভে বসে বিষ পান এবং আত্মহত্যার চেষ্টা।
অতীতে বিকাশ ভবনের সামনে ৫ শিক্ষিকা এই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। আর গত বৃহস্পতিবার রাতে কার্যত তুলকালাম হয়ে যায় কলকাতায়।
২০১৬ সালের মেধা তালিকাভুক্ত, অথচ “দুর্নীতি”র কারণে বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের নিয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ (agitation) ও অনশন চলছিল। দীর্ঘদিন ধরে এসএলএসটির (SLST) নবম, দ্বাদশের চাকরিপ্রার্থী তাঁদের অবস্থান-বিক্ষোভ করছিলেন।

ধর্মতলা থেকে লালবাজার, ১৬ই জুন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দিনভর বেনজির কাণ্ডের সাক্ষী ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র। টানা ৭০ দিন ধরে শহিদ মিনার লাগোয়া মাতঙ্গিনী মূর্তির নীচেই চলছিন চাকরির দাবিতে লড়াই।
বৃহস্পতিবার সেই এসএলএসটি চাকরিপ্রার্থীদের অনশন মঞ্চেই পুলিশ আসে বিকেল ৫টা নাগাদ। শুরু হয় ধস্তাধস্তি টানা হেঁচড়া। পুলিশের বক্তব্য ছিল, চাকরিপ্রার্থীদের অবস্থান-বিক্ষোভ এর সময়সীমা নির্ধারিত হয়েছে কোর্টের নির্দেশে। আর সেই সময়সীমা হল সর্বোচ্চ বিকেল ৪টে। কিন্তু বারংবার উঠে যাওয়ার অনুরোধ জানালেও অবস্থানের জায়গা ছাড়ছিলেন না চাকরি প্রার্থীরা।
এদিকে পুলিশ এসে জোর করে তাঁদের তুলে দিতে গেলেই শুরু হয় আরেক প্রস্থ গন্ডগোল। আটক হন একাধিক আন্দোলনকারী। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, জবরদস্তি প্রিজন ভ্যানে তুলে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজারে। তবে লকআপেও থামেনি বিতর্ক। বরং সেখানে বিতর্ক বাড়ে। যা ঘিরে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে কার্যত উত্তাল হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতি।

জানা গিয়েছে, পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির পর লকআপে অসুস্থ হয়ে পড়েন ৪ জন। হঠাৎ করে চারদিকে খবর রটে যায়, লকআপের বাথরুমে ফিনাইল (Phenyl) খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ৪ জন।
এখানে উঠে আসে প্রথম প্রশ্ন। ১) লালবাজারের লকআপ থেকে এই খবর কে বা কারা বাইরে পাঠালেন?
aajkhobor.com এর হাতে এসে পৌঁছেছে বিশেষ এই অডিও ক্লিপ। যেখানে আন্দোলনকারী এক চাকরিপ্রার্থী নিজেই জানাচ্ছেন, তাঁরা ফিনাইল খেয়েছেন।


চাকরির দাবিতে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সেখানে আত্মহত্যার চেষ্টা করার পরে কেন নিজেরাই ফিনাইল খেয়েছেন বলে ফোন করে জানাচ্ছিলেন ওই চাকরিপ্রার্থীরা? এই প্রচার এর আসল উদ্দেশ্য কী?

লালবাজারের লকআপে আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগে শোরগোল পড়ে যায়।
এখানেই উঠে আসে দ্বিতীয় প্রশ্ন।
২) পুলিশ এবং ওয়াকিবহাল মহল স্পষ্টতই জানাচ্ছে, লোকাতে আলাদা করে কোনও বাথরুম থাকেনা। সে ক্ষেত্রে এতজন বিক্ষোভকারীর মধ্যে আলাদা করে চারজন কোথায় ফিনাইল খেলেন?
উল্কার গতিতে খবর ছড়িয়ে পড়তেই এসএসকেএম (SSKM) হাসপাতালে পৌঁছয় বাম-বিজেপির প্রতিনিধি দল। এসএসকেএম হাসপাতালে হদিশ না পেয়ে রাতভর থানায় থানায় ছুটে বেড়ান সিপিএমের (CPIM) যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের (DYFI) রাজ্য সম্পাদক মীণাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের (Minakshi Mukherjee)।
প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে মীনাক্ষীর সেই ভিডিও। সূত্রের খবর, ভোরে ময়দান থানাতেও খোঁজ নেন মীনাক্ষী।


চরম বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। উঠে আসে তৃতীয় প্রশ্ন।
৩) কোথা থেকে এই খবর পেয়েছিলেন মীনাক্ষী? তথ্য গোপনের অভিযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন তিনি। শিক্ষা ক্ষেত্রে অরাজকতা চলছে বলে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে একের পর এক সংবাদমাধ্যমকে বক্তব্য দিতে থাকেন তিনি।
অথচ সেই ৪ জন “ফিনাইল খাওয়া” চাকরিপ্রার্থী তখনও অধরা।

শুক্রবার ভোর ৫টায় ময়দান (Maidan) থানা থেকে বেরিয়ে মীনাক্ষী জানান, মোট ৬৭ জনকে আটক করেছে পুলিশ। ৪ জন অসুস্থ হয়েছিল। এসএসকেএমে চিকিৎসা হয়েছে। তাঁদের কী কারণে চিকিৎসা করাতে হয়েছে কেউ কিছু বলছে না। চাকরি প্রার্থীরা ছাড়া পেলে তবেই বোঝা যাবে।
সালমান শেখ, মাজিজুর রহমান, ঝন্টু হালদের, ইন্দ্রজিৎ মন্ডল। এই ৪ জন অসুস্থ আন্দোলনকারী সহ বাকিদের খোঁজ মেলে শুক্রবার।


অথচ বৃহস্পতিবার রাতেই একদিকে বাম যুব সংগঠনের একাধিক নেতা নেত্রী ছুটে বেড়াতে থাকেন শহরজুড়ে। অন্যদিকে সেদিন রাতেই বিজেপির পক্ষ থেকে এসএসকেএম-এর বাইরে শুরু হয় ধর্না অবস্থান।
উঠে আসে চতুর্থ প্রশ্ন।
৪) কোন সূত্র থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে বিজেপি ও সিপিএমের তরফে মধ্যরাতে এই রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছিল?

এদিকে ধর্মতলায় বৃহস্পতিবার যে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে, তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে পুলিশের দাবি, কোর্টের শর্ত মানছিলেন না আন্দোলনকারীরা। সেই কারণেই অভিযান।
আবার পুলিশ সূত্রে খবর পাওয়া গেছে, উপর মহলের একাংশের নির্দেশ ছিল চাকরিপ্রার্থীদের টেনেহিঁচড়ে প্রিজনভ্যানে তোলার পর বিষয়টি যেন আর বাড়ানো না হয়। কারণ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি হয়েছিল পুলিশের ভূমিকায়। কিন্তু আন্দোলনকারীদের কয়েক জন থানার ভেতরে ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন এবং হাতাহাতি করেন। শারীরিকভাবে আক্রান্ত হন এক পুলিশকর্মী।


হলে প্রাথমিকভাবে শুক্রবার এই আন্দোলনকারীদের ছেড়ে দেবার কথা ভাবা হলেও পরে তাঁদের বিরুদ্ধে “জামিন অযোগ্য” ধারায় মামলা দেওয়া হয়। আদালত থেকে আগামী ২০ জুন পর্যন্ত “পুলিশ কাস্টোডি” (Police Custody) দেওয়া হয়েছে এই চাকরিপ্রার্থীদের।
সবমিলিয়ে আপাতত কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে।
১) নিছক নিজেদের আন্দোলনকে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই কি ফিনাইল খাওয়ার কথা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই চাকরি প্রার্থীরাই?
২) আগাম পরিকল্পনা করে কয়েকজন আন্দোলনকারী সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ফিনাইল। পুলিশ লকআপে নয়, প্রিজন ভ্যানে বসেই সেই ফিনাইল এর কিছুটা খেয়ে ছিলেন তারা? পুলিশ কেন তা বুঝতে পারল না? নজরদারির গাফিলতি?
৩) বিরোধী রাজনৈতিক দল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে অথবা আন্দোলনের পাশে থাকবে সেটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সেই আন্দোলন বা আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে সম্যক খবর না নিয়েই তড়িঘড়ি তারমধ্যে যুক্ত হয়ে পড়া কি আদৌ পরিণত ভাবনার পরিচয়?

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *