আজ খবর ডেস্ক: ২০১৪ নাকি ২০১৬? পুরো দায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের (Patha Chatterjee) নাকি খানিকটা দায় ব্রাত্য বসুর ওপরেও বর্তায়?


শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি (SSC Scam) নিয়ে যেদিন থেকে রাজ্য জুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে, পাশাপাশি উঠে এসেছে এই প্রশ্নগুলো।
গোটা বিষয়টির সঙ্গে অথবা বলা ভাল, স্কুল সার্ভিস কমিশনের চাকরি প্রার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে যারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাঁরা কিন্তু সামনে আনছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অভিযোগ, ২০১৪ বা তৃণমূল সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে অর্থাৎ ২০১৬ নয়, বরং রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের পরেই একটু একটু করে শুরু হয়েছিল দুর্নীতি।
২০১১ সাল থেকেই প্রতিবছর নিয়ম করে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার যে রুটিন চালু ছিল, তা ধাক্কা খায়।


চাকরির নোটিফিকেশন, পরীক্ষা এবং ফল প্রকাশ! গোটা প্রক্রিয়া মিলিয়ে একেকটি ধাপের সময় লেগেছে দুই থেকে তিন বছর।
এভাবেই বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে চাকরিপ্রার্থীদের।
আদালতের নির্দেশে গোটা বিষয়ের তদন্তভার কেন্দ্রীয় এজেন্সির (CBI/ ED) হাতে যাওয়ার বহু আগে থেকেই রাজ্য জুড়ে চলেছে এইসব চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন, বিক্ষোভ, ধর্ণা।

স্কুল শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মূলত তিনটি ধাপ অনুসরণ করা হয়।
১) প্রাইমারি/টেট
২) আপার প্রাইমারি
৩) এসএলএসটি (৯-১২)
এবার আসা যাক, চাকরি প্রার্থীদের অভিযোগ অনুযায়ী কী ভাবে গত প্রায় ১০ বছর ধরে বেনিয়ম চলছে সেই প্রসঙ্গে।
১৯৯৭ সালে তৈরি হয় স্কুল সার্ভিস কমিশন।


যদিও সে সময় প্রাইমারিতে নিয়োগ হত জেলা প্রাইমারি বোর্ডের মাধ্যমে, প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে ডাক পেয়ে। ২০০৮ সালে প্রথম প্রাইমারি টেটের (TET) পরীক্ষা হয়। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবার ২০১১ সালের ডিসেম্বরে এসএসসি নোটিফিকেশন জারি হয়। পরীক্ষা হয়েছিল ২০১২ সালের জুনে। ফল প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের আগস্টে।
চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, ওই পরীক্ষায় কমবেশি ১লক্ষ ৭৬ হাজার পরীক্ষার্থী পাশ করেন। এর মধ্যে প্রায় ৩৭ হাজার সাবজেক্টে (নির্দিষ্ট বিষয়ে) পাশ করেন। এদের মধ্যে থেকে নিয়োগ করা হয়েছিল ৩৫হাজার ৬০০ জনকে। চাকরি না পাওয়া বাকিরা আদালতে মামলা করেছিলেন, যা এখন ও চলছে।


চাকরি না পাওয়া এই হবু শিক্ষকরা প্রথম বিক্ষোভ দেখান এসএসসি অফিসের সামনে ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে। বলা যেতে পারে তখনই প্রথমবার আমজনতার নজরে আসেন এই চাকরি প্রার্থীরা। প্রকাশ্যে আসে মেধা তালিকায় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। তৎকালীন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র কথা বলেছিলেন তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। চাকরি প্রার্থীরা বলছেন, এর ফলে কয়েকজনের চাকরি মেলে। বাকিরা হাতে টেট পাশ সার্টিফিকেট নিয়ে এখন ও বেকার।

২০১৩ সালে প্রাইমারি টেট পরীক্ষা নেওয়া হয়। শিক্ষা দপ্তরের দায়িত্ব তখন নতুন শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু।
বেশ কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী জানাচ্ছেন, ২০১৩ সালের ৩১শে মার্চ বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলন করে ব্রাত্য বসু জানিয়েছিলেন, ৪৫ লক্ষ চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষা দিয়েছেন। যা রাজ্যে রেকর্ড।
মাত্র ৬মাসের মাথায় এই পরীক্ষার ফল বেরোয়। সেসময় শিক্ষামন্ত্রী (ব্রাত্য বসু) জানিয়েছিলেন, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৮ লক্ষ। ঠিক এখানেই প্রশ্ন তুলছেন চাকরি প্রার্থীরা। ৪৫ লক্ষ্য থেকে কিভাবে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাফে ১৮ লোক্ষতে নেমে এল?


সে সময় মেধা তালিকায় ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। চাকরি না পাওয়া হবু শিক্ষকদের অভিযোগ, সে বছর চাকরি পেয়েছিলেন দুই হেভিওয়েট তৃণমূল কংগ্রেস নেতার সন্তান। একজন অনুব্রত মণ্ডলের মেয়ে আর দ্বিতীয় জন আরাবুল ইসলামের ছেলে। (চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতেই বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা হল)।

২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের পর আবার দুটি চাকরির বিজ্ঞপ্তি সামনে আসে। প্রাইমারি ও আপার প্রাইমারিতে শিক্ষক নিয়োগ হবে। এই সময় কেন্দ্রীয় সংস্থার তরফে জানানো হয়েছিল, প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় বসার ক্ষেত্রে DLED এবং আপার প্রাইমারি ও SLST পরীক্ষায় বসার ক্ষেত্রে B.ED বাধ্যতামূলক।
নির্দিষ্ট এই ডিগ্রি না থাকা থাকার পরেও চাকরিপ্রার্থীদের পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। কোর্টে মামলা হয়। রাজ্য সরকারের তরফে জানানো হয়েছিল, শিক্ষকতার এই বিশেষ ট্রেনিং নেওয়া চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা রাজ্যে যথেষ্ট নয়। তখন আরেকটি মামলা হয়েছিল যাতে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি কান্নান রায় দিয়েছিলেন, পরীক্ষায় পাশের ক্ষেত্রে প্রথম সুযোগ দিতে হবে DLED/ B. ED প্রার্থীদের। তারপরেও সিট ফাঁকা থাকলে সুযোগ পাবেন যাদের এই নির্দিষ্ট ডিগ্রি নেই, তাঁরা।

এরপরে ২০১৫ সালে প্রাইমারি টেট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ বলছেন, এই যে মানিক ভট্টাচার্যকে এখন ইডি ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তার কারণ লুকিয়ে রয়েছে ওই প্রশ্নপত্র ফাঁসের রহস্যে।
২০১৭ সালে ওঠে নতুন অভিযোগ। মধ্যরাত্রে এসএমএসের মাধ্যমে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয় চাকরি প্রার্থীদের, কাউন্সেলিং ও শুরু হয়। আবার অভিযোগ ওঠে, নিয়মের ফাঁক গলে চাকরি পেয়েছেন বহু। আন্দোলন ও মিছিল করেন বামপন্থীরা।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে ৫ দিন কাটাতে হয়েছিল সিপিআইএম ছাত্র যুব ফ্রন্টের ৮ নেতাকে। যাঁদের মধ্যে ছিলেন ইন্দ্রজিৎ ঘোষ, সায়নদীর মিত্র, মধুজা সেন রায় প্রমুখ।
কার্যত প্রতিবছর নিয়ম করে চাকরি না হলেও মামলা হয়েছে মূলত কলকাতা হাইকোর্টে। যেমন একটা সময়ে রাজ্য সরকার বলেছিল, শিক্ষকতার বিশেষ ডিগ্রি না থাকলে চাকরি হবে না। চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ পরবর্তীকালে এমন অনেক প্রার্থী চাকরি পেয়েছেন যাদের এমন কোনও ডিগ্রী বা ডিপ্লোমা নেই। এদের চাকরি হয়েছে টাকার বিনিময়ে। “নট ইনক্লুডেড” তালিকাভুক্ত বহু চাকরিপ্রার্থী এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

ওয়াকিবহাল মহল বলছে, ২০১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ কম-বেশি ২৬৯ জনকে চাকরি দেয়। অভিযোগ ছিল পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুল রয়েছে। সেই নিয়ে ফের মামলা হয়। এরপরে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের পক্ষ থেকে আদালতে জানানো হয়, এই ২৬৯ জনকে চাকরি দেওয়া হচ্ছে তার কারণ, এরা অকৃতকার্য হয়েছিলেন কিন্তু মাত্র ১ নম্বর করে বাড়িয়ে দেওয়ায় প্রত্যেকেই পাশ করেছেন। প্রশ্ন ওঠে, কেন এদের হঠাৎ ১ নম্বর করে বাড়ানো হল?
উত্তরে সংসদ জানায়, প্রশ্নপত্রে ভুল ছিল, তাই এই বাড়তি নম্বর। ২০২২ অর্থাৎ চলতি বছরের মে মাসে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই ২৬৯ জনের চাকরি খারিজ করেন। ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন।

একদিকে যেমন গান্ধী মূর্তির পাদদেশে ৫০০ দিনের ও বেশি সময় ধরে চাকরি প্রার্থীদের আন্দোলন চলছে, অন্যদিকে আজ ও কসবায় বিক্ষোভ দেখিয়েছেন ২০১৪ সালের টেট পাশ নন ইনক্লুডেড চাকরি প্রার্থীরা।
২০১৯ সালে আপার প্রাইমারি পরীক্ষা হয়। প্রায় ১৮ হাজার চাকরিপ্রার্থী ইন্টারভিউতে ডাক পেয়েছিলেন। সিট ১৪ হাজার। এখানেও একাধিক মামলা হয়েছে এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ার থমকে রয়েছে।


পরের ধাপে রয়েছে এসএলএসটি। ২০১৬ সালে পরীক্ষা হয়েছিল। ২০১৭ সালের মে-জুন মাস নাগাদ ফল বেরোয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে নিয়োগ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ৫ সদস্যের একটি কমিটি তৈরি হয়েছিল নিয়োগ প্রক্রিয়া সামলানোর জন্য। মাথায় ছিলেন শান্তি প্রসাদ সিনহা। সিরিয়ালের পরে ইডির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে।
এসএলএসটি মোট চাকরি পেয়েছেন ১৮ হাজার। ওয়েটিং লিস্টে রয়েছেন আরও ৫হাজার।


প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরে অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারী এই সময় চাকরি পান। পরবর্তীকালে হাইকোর্টের নির্দেশে চাকরি বাতিল হয়েছে অঙ্কিতার। ফেরত দিতে হয়েছে মাইনের টাকা। সেই জায়গায় যোগ্য হিসেবে চাকরি পেয়েছেন ববিতা সরকার।
প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি নগদ টাকা ছাড়াও প্রচুর সম্পত্তি উদ্ধার হচ্ছে। চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের সংখ্যা ২০ হাজারের ও বেশি। মাথাপিছু ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা দিয়েছেন এরা।
ফলে খুব সহজেই অনুমান করা যায়, আসলে ঠিক কত টাকার বেনিয়ম হয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *