আজ খবর ডেস্ক:
Kali Puja 2022 পশ্চিমবঙ্গের কালীপুজোর ইতিহাস বহুদিনের। এই শহরের বেশ কিছু বাড়িতে ১০০বছরেরও বেশি সময় ধরে কালীপুজো (Kolkata Kali Puja) হয়। এখন পাড়ায় ক্লাবে ক্লাবে কালীপুজো হলেও এইসব প্রাচীন, ঐতিহ্যশালী কালী পুজো দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বছরের এই সময়টায় মানুষ ছুটে আসেন।


দীপাবলির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তাই এক নজরে দেখে নিন, মহানগরীর কোন কোন পুজো রয়েছে আকর্ষণের কেন্দ্রে।
আর, ঘূর্ণিঝড়ের (Cyclone Sitrang) ভ্রুকুটি থাকলেও সময় করে দেখে নিতে পারেন এমন কয়েকটি পুজো। অনেক জায়গায় মিলে যাবে ভোগও।

১)দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির (Dakahineswar Kali Temple)

জনপ্রিয়তার নিরিখে দক্ষিণেশ্বরের কালী পুজো শীর্ষস্থানীয়। একটি বার এখানকার প্রতিমার দর্শন পেতে সারা বছরই ছুটে আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। দক্ষিণেশ্বরে দেবী পূজিতা হনn”মা ভবতারিণী” রূপে। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে, দীপান্বিতা কালীপুজোর দিনে এখানে দর্শনার্থীদের ঢল নামে!

২) কালীঘাট (Kalighat Temple)

হিন্দুশাস্ত্র মতে, মা কালী দেবদেবীদের মধ্যে সবথেকে জাগ্রত। একান্নপীঠের একপীঠ দেবতীর্থ কালীঘাটের মা কালী খুবই জনপ্রিয়। ভক্তদের মধ্যে কথিত আছে, মন্দির সংলগ্ন একটি কুণ্ডে সতীর ডান পায়ের একটি আঙুল পাওয়া গিয়েছিল। লোকচক্ষুর অন্তরালে যা নাকি এখনও রক্ষিত আছে মন্দিরের সিন্দুকে।

৩) টালিগঞ্জ করুণাময়ী কালী মন্দির (Tollygunj Karunamoyee Kali Temple)

ইতিহাস বলে, বড়িশার নন্দদুলাল রায়চৌধুরীর কন্যা করুণাময়ী মৃত্যুর পরে বাবাকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন। একটি বিশেষ কষ্টিপাথর দেখিয়ে বলেছিলেন , তিনি এই রূপে থেকে যাবেন। তাই তাঁর বাবা সেই কষ্টিপাথর থেকে কালীমূর্তি গড়ে “মা করুণাময়ী” নামে পুজো করা শুরু করেন। বিখ্যাত এই পুজো দেখতে আজও ভিড় জমান মানুষ। কালীপুজোর আগের রাত থেকেই ভক্তদের লম্বা লাইন পড়ে মন্দিরের সামনে রাস্তায়।

৪) ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি (Thanthania Kali Temple)

উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির অতি প্রাচীন ও জনপ্রিয়। জনশ্রুতি, অতীতে ডাকাতদের আক্রমণ থেকে সতর্ক করার জন্য এই মন্দিরের ঘণ্টা বাজিয়ে ঠনঠন শব্দ করা হত। সেই থেকেই এই মন্দিরের নাম ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি। প্রতি বছর এই কালীমূর্তিকে নতুন ভাবে সাজানো হয়। তা দেখতে জমায়েত হয় অগণিত ভক্তের।

৫) ফিরিঙ্গী কালীবাড়ি (Firingi Kali Temple)

১৯ শতকে পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত অ্যান্টনি হেন্সম্যান নামে এক কবিয়াল এই দেবস্থানে এসেই উপলব্ধি করেছিলেন, খ্রিস্ট আর কৃষ্ণ একই। তাঁর অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে পূজিতা হন সিদ্ধেশ্বরী কালী, যাঁকে ভক্তরা “ফিরিঙ্গি কালী” নামেও পুজো করেন।

এবার আসা যাক কলকাতার বেশ কিছু পারিবারিক কালীপুজোর কথায়। দুর্গাপুজোর মতই শহরের বিভিন্ন জমিদার বাড়িতে বছরের পর বছর ধরে নিষ্ঠা এবং পরম্পরায় পালিত হয় কালীপুজো।

১) হাটখোলায় রামচন্দ্র দত্ত’র বাড়ির পুজো

আন্দুল দত্তচৌধুরী পরিবারের রামচন্দ্র দত্ত আঠারো শতকের শেষার্ধে সাবেক গোবিন্দপুর অঞ্চল থেকে এসে চিৎপুর-হাটখোলা (Chitpur Hatkhola) অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। এখনকার নিমতলা শ্মশানের কাছে রামচন্দ্রের আদি ভদ্রাসন ও ঠাকুরদালান। এই পরিবারের মদনমোহন দত্ত প্রাসাদোপম ওই বাড়িতে দুর্গাপুজো ছাড়াও কালীপুজোতে আড়ম্বর ও জাঁকজমক করতেন। মদনমোহন দত্ত লেনের এই ঠাকুরদালান তিন খিলান ও দু’দালান বিশিষ্ট। এই বাড়ির সদস্যেরা বাড়ির সামনে বিশাল আটচালা মন্দির-সহ দুর্গেশ্বর নামে এক বিশালাকৃতি শিব প্রতিষ্ঠা করেন। ওই কালো পাথরের তৈরি শিবলিঙ্গ কলকাতার অন্যতম বৃহৎ শিবলিঙ্গগুলোর অন্যতম। পরে বাড়িটি উত্তরাধিকার সূত্রে ঘোষ পরিবারের হাতে যায়। ঠাকুরদালান রক্ষণাবেক্ষণ হলেও অপটু সংস্কারের ফলে সাবেক দালানের প্রাচীন অলঙ্করণের বেশিরভাগই এখন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পুজো কিন্তু, বজায় আছে আজও। ডাকের সাজের দক্ষিণাকালী মূর্তিতে পুজো হয় এখানে।

২) সিমলার রামদুলাল সরকারের পুজো।

উত্তর কলকাতার সিমলা স্ট্রিট আদতে স্বামী বিবেকানন্দের পাড়া। জাহাজ-ব্যবসায়ী রামদুলাল দেসরকার এই সরকার পরিবারের প্রধান ছিলেন। ২৪পরগণার রেকজানি গ্রামে ছিল তাঁর পৈতৃক বাড়ি। ছোটবেলায় ঠাকুমার হাত ধরে কলকাতায় এসে দত্তবাড়ির কর্তা মদনমোহন দত্তের জাহাজ-ব্যবসায় চাকরি নেন। তাঁর সততায় মুগ্ধ হয়ে মদনমোহন তাঁকে নিজে ব্যবসা করার পরামর্শ দেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে যে কয়েজনের চেষ্টায় বাংলার সঙ্গে আমেরিকার বর্হিবাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটেছিল, রামদুলাল তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ৬৭ই বিডন স্ট্রিটের ভদ্রাসনে দুর্গাপুজো, কালীপুজো ইত্যাদি আরম্ভ করেন। পুজোটি তাঁর দুই ছেলে সাতুবাবু বা ছাতুবাবু ও লাটুবাবুর আমল থেকে জাঁকযমকপূর্ণ হয়ে ওঠে। দক্ষিণাকালীর পুজো হয় এই বাড়িতে।

৩) দর্জিপাড়া মিত্রবাড়ির পুজো

দর্জিপাড়া নীলমণি মিত্র স্ট্রিটের মিত্রবাড়ির কালীপুজো বেশ প্রাচীন। আড়িয়াদহ থেকে ভাগ্যান্বেষণে সুতানুটি অঞ্চলে আসেন এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা জগন্নাথপ্রসাদ মিত্র। তাঁর পৌত্র দুর্গাচরণ ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার ‘কোর্ট জুয়েলার’। এছাড়াও তাঁর বহুবিধ ব্যবসা ও নুনের দেওয়ানি ছিল। এই পরিবারের নীলমণি মিত্রর পৌত্র প্রাণকৃষ্ণ কিশোর বয়সে একবার খেলার ছলে কালী মূর্তি গড়েন। সেই থেকে পুজো আরম্ভ।
পরিণত বয়সে তিনি ভদ্রাসন সহ ঠাকুরদালান নির্মাণ করে দুর্গাপুজোও আরম্ভ করেন। কিশোর বয়সে দেবীমূর্তির শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা না জানার ফলে প্রাণকৃষ্ণ ভুল করে শিবের বুকের উপরে কালীর বাঁ পা রেখে দক্ষিণাকালীর প্রতিমা তৈরি করেছিলেন। সেই ‘ভুল’ বজায় রেখে আজও সেই ভাবেই গড়া হয় এখানকার প্রতিমা।

৪) তারক প্রামাণিকের বাড়ির পুজো

প্রামাণিক বংশের মদনমোহন প্রামাণিক হুগলির সাহাগঞ্জ থেকে কলকাতায় এসে কাঁসা-পিতলের ব্যবসা আরম্ভ করেন। তাঁর পুত্র গুরুচরণ পৈতৃক কাঁসার ব্যবসার পাশাপাশি সালকিয়ায় গঙ্গার ধারে ‘ক্যালেডোনিয়া ডক’ নির্মাণ করে জাহাজ মেরামতির কারবার আরম্ভ করেন। তিনি সিমলা অঞ্চলে ভদ্রাসন নির্মাণ করে দুর্গাপুজো, কালীপুজো ও কার্তিকপুজো শুরু করেন। পুজোর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে পরিবারের প্রাণপুরুষ গুরুচরণের পুত্র তারকনাথ প্রামাণিকের সময়কালে। প্রামাণিক বংশের কালীপুজো হয় কালিকাপুরাণ মতে। দক্ষিণাকালীর বাঁ পায়ে বিছে আঁকা থাকে। কালীপুজোয় বলি দেওয়া হয় না। কাঁসা-পিতলের কারখানা এখন না থাকলেও, অমাবস্যার শেষে প্রতিপদ তিথিতে ব্যবসার যাবতীয় যন্ত্রপাতি, বাটখারা ইত্যাদি পুজো করা হয়।

৫) চক্রবেড়িয়া মিত্রবাড়ি

পলাশির যুদ্ধের পরে নতুন কেল্লা (এখনকার ফোর্ট উইলিয়ম) তৈরির জন্য সাবেক গোবিন্দপুর অঞ্চলের বাসিন্দাদের পুনর্বাসন দেওয়া হয় বিভিন্ন জায়গায়। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, এই পরিবারের প্রাণপুরুষ রামগোবিন্দ মিত্র ছিলেন সিরাজউদ্দৌল্লার দেওয়ান। আরও অনেকের সঙ্গে তিনিও ভবানীপুর অঞ্চলে পুনর্বাসন পেয়ে ঠাকুরদালান-সহ ভদ্রাসন তৈরি করে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে। শরিকি বিভাজনের কারণে পুরানো মিত্রবাড়ির প্রাচীন ভদ্রাসন এখন বহু ভাগে বিভক্ত। পাঁচ খিলান-যুক্ত বিশাল আকারের পুরনো ঠাকুরদালানটিও এখন আগের চেহারায় নেই। পাঁচটি খিলানের চারটিই ভেঙে গিয়েছে। পুজো হয় অবশিষ্ট একটি খিলানের মধ্যে। ঠাকুরদালানের বর্তমান ঠিকানা ২৬ চক্রবেড়িয়া রোড। এখানেও ডাকের সাজের দক্ষিণাকালীর মূর্তিতে পুজো হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *