সায়েদুল ইসলাম মন্টু:
ইলিশের বিচরণ কেবল বাংলাদেশের (Bangladesh) পদ্মা মেঘনার অববাহিকাতেই সীমাবদ্ধ নয়। সাগর থেকে তারা মায়ানমারের (Myanmar) ইরাবতী নদী এবং পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) ভাগীরথী-হুগলী নদীতে প্রবেশ করে। তা ছাড়া ইলিশের উপস্থিতি রয়েছে আরও সুদূরে। পূর্বের মেকং বদ্বীপ থেকে শুরু করে পশ্চিমের পারস্য উপসাগরেও দেখা মেলে তাদের।
আপনি যখন নিজ শহরের স্থানীয় বাজার থেকে একটি ইলিশ কিনবেন, সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল যে সেই মাছটি হবে নারী ইলিশ, যার পেটভর্তি ডিম। ইলিশের মরশুমে আক্ষরিক অর্থেই দেশের কোণে কোণে প্রতিটি বাজার উপচে পড়ে নারী ইলিশে। অথচ পুরুষ ইলিশ যেন অমাবস্যার চাঁদের মতই দুর্লভ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন অক্টোবর মাসে যখন ইলিশের প্রধান প্রজননের সময় চলে, তখন প্রায় সমপরিমাণ নারী ও পুরুষ ইলিশই নদীর উজান পেরিয়ে আসে মিষ্টি জলে। তাহলে এই পুরুষ ইলিশরা সব যায় কই? কীভাবে তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে স্রেফ উধাও হয়ে যায়?
মধ্য-সেপ্টেম্বরে আমি যখন চাঁদপুরে দেশের সর্ববৃহৎ ইলিশের পাইকারি বাজারে হাজির হলাম, আমি এ ব্যাপারটা দেখে খুবই অবাক হলাম যে মাটিতে সারি বেঁধে থাকা সকল ইলিশই নারী ইলিশ।
যে প্রশ্নটিকে সামনে রেখে আমি আমার যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেটিই ছুড়ে দিতে থাকলাম সকল ব্যবসায়ীর সামনে, সব পুরুষ ইলিশ কোথায় গেছে?
কিন্তু এত বড় বাজারের একটি লোকও আমাকে এই রহস্যের মীমাংসা সম্ভব, এমন কোনও বিশ্বাসযোগ্য জবাব দিতে পারলেন না।
“আমরা পুরুষ ইলিশ নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমরা এতেই খুশি যে সবগুলো মাছই নারী ইলিশ, আর তাদের পেটভর্তি ডিম। ক্রেতারাও এমন ইলিশই চায়, তাই এগুলোই বিক্রি হয়,” বললেন মাছ ব্যবসায়ী মিরাজ আহমেদ। হাজী সিরাজ এন্টারপ্রাইজ নামে তাঁর একটি ট্রেডিং হাউস আছে।
এদিকে মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে ওয়ার্ল্ডফিশ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। সেখানকার ইলিশ বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল ওয়াহাব বলেন, “ইকোফিশ প্রকল্প থেকে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজনন মরশুমে একটি ইলিশের ঝাঁকে নারী পুরুষের অনুপাত থাকে ৫৫:৪৫।”
তাহলে আমরা চারদিকে কেবল নারী ইলিশই দেখি কেন? কয়েক বছর আগে একই প্রশ্ন তাড়া করে বেড়ায় আরেক সাংবাদিক ও পপুলার সায়েন্সের লেখককেও। তিনিও চেষ্টা করেন রহস্যভেদের।
বেশ কয়েকজন মৎস্যজীবী ও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা জানতে পারেন, পুরুষ ইলিশ আসলে আমরা যতটা ভাবি ততটা বিরল নয়। জেলেরা তাঁদের জালে পুরুষ মাছও ধরেন, কিন্তু কোন মাছটি পুরুষ আর কোনটি নারী, তা তাঁরা আলাদা করতে পারেন না। কারণ পুরুষ ইলিশের কোনও জননাঙ্গ নেই।
নারী ইলিশরা যেভাবে নদীর জলে তাদের ডিম ছাড়ে, পুরুষ ইলিশরা জলে ঠিক সেভাবেই ছাড়ে তাদের বীর্য। আর এই দুটি জিনিস প্রায় একই রকম দেখতে। শুধু এটুকুই ব্যতিক্রম যে, পুরুষ ইলিশের ভেতরে ডিম থাকে না, কিন্তু সে কথা ডিম ছাড়া নারী ইলিশদের বেলায়ও প্রযোজ্য।
তাই কেবল একজন বিশেষজ্ঞের চোখই বলতে পারে কোন ইলিশ পুরুষ। জল থেকে জাল গোটানোর পর জেলেরা সবাই খুব মর্মাহত হয়ে পড়েন। জালে আটকা পড়া মাছগুলো ছিল আকারে ছোট এবং এরা দেখতেও ছিল তুলনামূলক ভাবে দুর্বল, ক্ষীণকায় ও অনাকর্ষণীয়। একটু ভাল ভাবে খেয়াল করতেই দেখা গেলো সেখানকার প্রায় ৬২ শতাংশ মাছই ছিল পুরুষ। এটি ছিল প্রধানত একটি পুরুষ ইলিশের ঝাঁক, যা বেশ বিরল একটি ব্যাপার। বস্তুত একটি মাছের ঝাঁকে সাধারণত ৪০-৪৫ শতাংশ ইলিশ পুরুষ হয়ে থাকে।
নারী ইলিশের শরীরে যে ঝকমকে চেকনাই দেখা যায়, পুরুষ ইলিশের গায়ে তা অনুপস্থিত। তারা দেখতে কদাকার না হলেও কিছুটা অনাকর্ষণীয় তো বটেই।
গতানুগতিক মাছের বাজারে তাই আর এসব পুরুষ ইলিশের ঠাঁই হয়না। জেলেরা সে গুলোকে আলাদা করে এবং পাঠিয়ে দেন লবণ মাখিয়ে শুকোনোর জন্য। স্থানীয় কৌশলে সংরক্ষিত এসব ইলিশকে বলা হয় “নোনা ইলিশ”।
স্যামন, স্মেল্ট, হিকরি শ্যাড, ল্যাম্প্রে এবং গালফ স্টার্জনের মত ইলিশও একটি অ্যানাড্রোমাস মাছ। যারা একটি বিশেষ ধরনের জীবনচক্র অনুসরণ করে। তাদের জন্ম হয় নদীর মিষ্টি জলে। এরপর অভিবাসিত হয়ে আট মাস তারা সমুদ্রে চলে যায় এবং সেখানেই কৈশোর পেরিয়ে পরিণত মাছ হয়ে ওঠে। তারপর তারা আবার নদীতে ফিরে আসে প্রজননের উদ্দেশ্যে।
আগেই বলা হয়েছে, ইলিশ যৌনকর্মে লিপ্ত হয় না। পুরুষ মাছ তাদের ফোমের মত শুক্রাণু ছেড়ে দেয় এবং নারী মাছ ওই ফোম-সদৃশ ব্রথের ওপর তাদের ডিম্বাণু ছেড়ে সেগুলোকে নিষিক্ত করে।
অক্লান্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে গবেষকেরা অবশেষে ইলিশের প্রজনন কালের দিনক্ষণ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলা আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার আগে-পরে পদ্মা মেঘনা নদীসহ এর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা ধরে ইলিশ মাছ উজান বেয়ে মিষ্টি জলে আসতে থাকে।
নদীর শক্তিশালী স্রোতের ফলে নারী ও পুরুষ উভয় ইলিশের শিরদাঁড়া বেয়েই শিহরণ বয়ে যায়। এতে তারা তীব্র যৌন উদ্দীপনা অনুভব করে। ফলে তুমুল বেগে উজান বেয়ে সাঁতরাতে থাকে।
পদ্মা মেঘনার মোহনায় যে পরিমাণ ইলিশ দেখা যায়, আর কোথাও এই মাছকে এত বেশী দেখা যায় না। তা ছাড়া সব ইলিশের পেটভর্তি ডিমও থাকে না।
আমরা বাজারে ডিমহীন নারী ইলিশও দেখতে পাই। ডিম ছাড়ার পর ফিরতি যাত্রায় নারী মাছদের শরীর খুব ক্লান্ত থাকে। তখন তাদেরকে পুরুষ ইলিশের মতই অনাকর্ষণীয় দেখায়। ফলে একজন সাধারণ জেলের পক্ষে একটি ইলিশ নারী না পুরুষ, তা বোঝা আরও দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় ভাষায় জেলেরা তাদের ডাকে “পাইক মাছ” বলে।
একজন জেলে বলেছেন, “আমরা জানি এবং শুনেছিও আমাদের ধরা মাছের মধ্যে পুরুষ ইলিশ আছে। কিন্তু আমরা তাদের শনাক্ত করার ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। আমাদের একমাত্র চিন্তার বিষয়- মাছের আকার ও চেহারা। আমাদের জন্য মাছ দুরকম, ভালো মাছ ও পাইক মাছ।”
চাঁদপুর জেলার হাইমচরের কাছাকাছি মেঘনার মোহনা ইলিশ ধরার জন্য খুবই বিখ্যাত এলাকা। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে আমি একটি গুজব শুনতে পাই। জলে বীর্য ছাড়া এবং বাহ্যিকভাবে ডিম নিষিক্ত করার পর পুরুষ ইলিশ এক ধরণের লিঙ্গ রূপান্তরের (Trans Gender Form) মধ্য দিয়ে যায়। তারা পরিণত হয় নারী ইলিশে। যদিও গভেষকদের কাছে এমন কোনও প্রমাণ নেই। এখন পর্যন্ত কোনও গবেষণাই আমাদের এ ধরনের মেটামরফোসিসের ইঙ্গিত দেয়নি।