আজ খবর ডেস্ক- কথায় আছে ‘ইচ্ছে থাকলে মানুষ সব করতে পারে ‘ । কিন্তু প্রবল ইচ্ছে শক্তি যে শারীরিক প্রতিকূলতাকেও তুচ্ছ করে দিতে পারে তারই দৃষ্টান্ত রাখলো দুর্গাপুরের ২০ বছরের যুবতী দেবস্মিতা।

২০০১ সালের ১৬ ই এপ্রিল পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরে জন্ম হয় দেবস্মিতার। জন্মের পর পরই কিছু বোঝা না গেলেও ৬ মাসের মাথায় গিয়ে অনেক রকমের সমস্যা দেখা দিতে থাকে দেবস্মিতার মধ্যে ।
মুখ দিয়ে লালা পড়তে থাকা, সোজা হয়ে বসতে না পারার মতো বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয় তার । তারপর থেকে বহু নিউরো ডাক্তার দেখিয়ে, নানান ভাবে চেষ্টা করলেও আশার বাণী শোনাতে পারেননি কেউই। শেষে ভেলোরের এক নিউরো সার্জেন, ডা: থমাস জোসেফ বলেন – “ওর সেরিব্রাল পালসি নামের একটি রোগ হয়েছে। তবে ওকে কোনোদিনই হোমে দেওয়া যাবেনা। ফিজিও থেরাপি করাতে হবে,অনেক কথা ,কবিতা ,গান শোনাতে হবে, সাঁতার শেখাতে হবে, এবং অন্য পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার মতোই জেনারেল স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। শুধু মাত্র স্বাভাবিক জনজীবনের সঙ্গে তার মিলমিশ ঘটানোই এই রোগের একমাত্র ওষুধ।”

এরপর শুরু হয় দেবস্মিতার আসল লড়াই। তিন বছর বয়সে প্রথম স্কুলে ভর্তি করা হয় তাকে।
তারপর থেকেই মা, বাবা, মামা ইত্যাদির মতো ছোটো ছোটো শব্দ বলা শুরু করে সে । স্কুলে ভর্তি হবার প্রথম দিকে হাত মুঠো করে রাখতো , সেটাও আসতে আসতে খুলতে শুরু করলো সে।আসতে আসতে দেয়াল ধরে হাঁটারও চেষ্টা শুরু করলো। প্রথমে ছোট কবিতা বলা ,তারপর অন্য স্কুলে কবিতা প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছিল দেবিস্মিতা।

প্রথম অন্য স্কুলে গিয়ে কবিতা প্রতিযোগীতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমেই কবিতা জীবন শুরু হয় দেবিস্মিতার। প্রথম গুরু শম্পা রায়চৌধুরি । তারপর থেকে কখনোই ওকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি । কিন্তু কবিতার উত্তরণের সাথে সাথেই স্কুলে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছিলো দেবস্মিতাকে । পর পর চারটি স্কুল পরিবর্তন করার পর শেষমেষ দশম শ্রেণী ভালো ভাবে পাশ করে সে। এদিকে প্রচুর পুরস্কার , সম্মান ,অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দূর্গাপুরে নিজের একটা শক্ত জায়গা করে নিয়েছিল ও। মাত্র ১৩ বছর বয়সে দুর্গাপুরে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়- এর ওয়ার্কশপ ‘ব্রততী পরম্পরা’ তে প্রথম স্থান পেয়ে সরাসরি ওনার কলকাতার প্রতিষ্ঠানে আবৃত্তি শেখার সুযোগ পায় দেবিস্মিতা। সেখানে উর্মিমলা বসু , গৌরী ঘোষের মতো অনেক গুণী মানুষের সান্নিধ্য লাভ করে।
১৭ বছর বয়সে কলকাতার সুজাতা সদনে প্রথম শিল্পী হিসেবে কবিতার যাত্রা শুরু হয় দেবস্মিতার । ১৮ বছর বয়সে ভাবনা রেকর্ডস থেকে কোলকাতা প্রেস ক্লাবে রবীন্দ্র কবিতা সিডি প্রণমি প্রকাশ হয় তার। যদিও এই পথ খুব সহজ ছিল না তার কাছে। তারপর রবীন্দ্র সদন , বিড়লা একাডেমি ,শিশির মঞ্চ , ত্রিগুনাসেন মঞ্চ ,বাংলা একাডেমী সহ বিভিন্ন মঞ্চের হাত ধরে তার কবিতার বিকাশ ঘটে। ১৮ বছর বয়সে পঞ্চমবর্ষ বঙ্গ প্রমীলা কৃতী রত্ন সম্মান , মনোন সাহিত্য প্রত্রিকা থেকে সম্মান পায়।প্রাক্তন রাজ্যপাল কেশরী নাথ ত্রিপাঠী স্বয়ং সাক্ষাৎ করে দেবস্মিতার সাথে। এখন কিছু বাচ্চাকে সে কবিতা, আবৃত্তি পাঠ শেখায়। সদ্য বেঙ্গল বোর্ড থেকে ১২ ক্লাস পাশ করে এখন ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশ অনার্স পড়ছে দেবস্মিতা। তার বাবা দেবাশীষ নাথ, পেশায় ব্যাঙ্ক কর্মী। তিনি মেয়ের সম্পর্কে বলেন – ‘ ওর ইচ্ছে, ওর মতো মানুষের কাছে নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গড়ে তোলা ।’

দেবস্মিতার এই মনোবলকে সত্যিই কুর্নিশ জানাতে হয়। তবে এখনো দাঁড়াতে পারে না সে। তাই নিজের শারীরিক প্রতিকূলতাকে দমিয়ে এখনও সব জায়গায় বসে অনুষ্ঠান করে সে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *